সুচিত্রা সরকার |
রাস্তাটায় এমনিতে ভিড় লেগেই থাকে। বাস থামছে, কিছু লোক ভিড় ঠেলে ওঠে, কিছু লোক নামে। আবার কেউ কেউ বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাজধানীর গুলশান এক নম্বর গোলচত্বরের এটা সব সময়কার চিত্র। ২৩ অক্টোবর বিকেলেও এর ব্যতিক্রম চোখে পড়ল না। এই ভিড়ের মধ্যেই দুটো শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কী যেন খুঁজছে। খানিক পরেই উত্তরটা পাওয়া গেল। একজন পথচারী দাঁড়িয়ে কোমল পানীয় খাচ্ছিলেন। শিশুদের একজন তাঁর কাছে গিয়ে হাত বাড়ালেন। পথচারী বোতলে খানিকটা পানীয় রেখে বোতলটা দিয়ে দিলেন। শিশুটি পানীয়টুকু খেয়ে খালি বোতলটা তার পিঠের ঝোলায় ঢুকাল।
এগিয়ে গিয়ে কথা বলি ছেলেটার সঙ্গে। নাম জিজ্ঞেস করতেই হেসে বলল, ‘বোরহানউদ্দিন। তয় মায় ডাকে বিপ্লব।’
বিপ্লবের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ওদের তিন ভাইবোনসহ মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। ভাগ্যের সন্ধানে সন্তানদের নিয়ে বিপ্লবের মা আশ্রয় নেন রাজধানীর করাইল বস্তিতে। ইট ভাঙার কাজ করেন।এতে সংসার চলতে চায় না। এ জন্য মাকে সাহায্য করতেই বিপ্লব এই কাজ করছে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কত দিন ধরে এই কাজ করছ? খানিকটা ভেবে বলে, ‘এই ধরেন এক বছর। তয় আগে বাসাবাড়ির ময়লা ফেলতাম। সেইখানে অনেক টেকা পাইতাম। এহন সেখানে ময়লার গাড়ি হইছে, আমারে কেউ ময়লা দেয় না। কী আর করুম।’
কথায় কথায় বিপ্লব জানায়, ওর দিন শুরু হয় সকাল সাতটায়। উঠেই স্কুলে যায় সে। বস্তির পাশে এনজিওর একটা স্কুল আছে। সেখানেই তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে ও। স্কুলে পড়তে কেমন লাগে জানতে চাইলে সে বলে, ‘খুব ভালা লাগে। আমার তো ১৩ বছর। মাত্র থিরিতে পড়ি। তাড়াতাড়ি পড়ালেখা শেষ করতে চাই।’
‘বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?’
‘ইঞ্জিনিয়ার। সব রোডঘাট বানাইতে চাই। মাইনষ্যে কত ভালা কইব। সুনাম হইব।’
বিপ্লবের স্কুল ছুটি হয় দুপুর দুটোয়। তারপরই বাড়ি থেকে সাদা প্লাস্টিকের বস্তাটাকে কাঁধে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাগজ-প্লাস্টিক সংগ্রহ করলে হয়তো ৫০ বা ৬০ টাকা পায় সে। নিজেই বলে, ‘বস্তির লগেই একটা ভাঙারির দোকান আছে, সেইখানে সব টোকাইরা ভাঙারির কাগজপত্র বেচে। সেইখানে বেচি।’
‘টাকা পেয়ে কী করো?’
‘কী আর করুম। টেকা মায়েরে দেই। নানিরেও দিয়া দেই। নানি আমারে দুপুরে ভাত খাওয়ায়। আবার মন চাইলে সমুচা কিন্যা খাই।’ এতটুকু বলেই দৌড়ে গেল রাস্তার মাঝখানে। বাস থেকে একটা বোতল ফেলল কেউ। সেটা কুড়িয়ে আনল। চোখেমুখে রাজ্য জয়ের আনন্দ।
এবার একটু প্রসঙ্গটা পাল্টাই। জিজ্ঞেস করি, তুমি জান রাজনীতি কী?
বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে, ‘জানুম না ক্যান? হরতালে মিছিল করারে রাজনীতি কয়। আমরাও মিছিল করি। কিরে ঠিক না? প্রশ্নটা করেছে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে। ছেলেটি মাথা নেড়ে সায় দেয়। সে বিপ্লবের খালাতো ভাই। নাম কাদের। তারপর বিপ্লব বলে, ‘হরতাল হইলে মহাখালী যাই। গাড়ি, সিএনজিরে দৌড়ানি দেই। ওরাও টেকা দেয়। একবার তো টিভি গেটের সামনের একটা কাচ ভাঙছিলাম।’ নিজের দুষ্টুমিতে নিজেই হেসে ফেলে। হাসতে হাসতেই বলে, ‘হের লাইগ্যা আমগোরে এক হাজার টেকা দিছিল। এরপর থেইক্যা আমরা দুইজনেই বেশির ভাগ সময় যাই।’
ওর কাছে আবারও জানতে চাই, সরকার কাকে বলে আর নির্বাচনই বা কী?
‘দেশটা যে চালায় তারে সরকার কয়।’
‘তুমি সরকারের কাছে কী চাও?’
খানিকটা চিন্তা করে। চোখেমুখে খানিকটা উদ্বেগ। বলে, ‘চাইলেই কি পামু! যদি পাই, তয় আমি পড়ালেখা করতে চাই। আমার এই খালাতো ভাইও পড়তে চায়। আর একটা জিনিস খাইতে চাই। আমগো ইসকুলে স্বাধীনতার দিন বিরানি খাইতে দিছিল। হেই রকম স্বাদের বিরানি সব সময় খাইতে চাই।’
তারপর হতাশ গলায় বলে, ‘চাইলেও লাভ নাই। হেরা তো আমাগো কথা চিন্তা করে না। হের লাইগ্যা আমি অনেক বড়লোক হইতে চাই। বড়লোক হইলে গরিবগো ঘর বানাইয়্যা দিমু। সাহায্য করুম। গরিবেরা তো সকালে ওইঠ্যা দুইট্যা দানাও খাইতে পারে না। তারা য্যান ভাত খাইতে পারে, এইটা চাই আমি।’ বলতে বলতে চোখজোড়া ভরে ওঠে জলে।