শুরুতে কেমন যেন সব কিছুতেই খটকা লাগতো, সবে মাত্র কৈশোরের উচ্ছলতার গণ্ডি পার করে প্রবাসের মাটিতে পা দিয়েছি, বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে চলনে, বলনে, বেশভূষা, বন্ধু সমাজে নিজেকে সব সময় বেশ আধুনিকই ভেবে এসেছি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমাজে আধুনিক হবার জন্যে একজন যুবকের যে সব গুণাবলী থাকার প্রয়োজন ছিল আমার ধারনা ছিল আমার সব কিছু অর্জন করা হয়ে গেছে, যেমন খুব বেশী বেশী ইংরেজি গান শুনতাম, বাসায় প্রতি সপ্তাহে রিডার ডাইজেস্ট, নিউস উইক আর টাইম ম্যাগাজিন তো থাকতোই বিভিন্ন দেশের নামকরা শিল্পীদের নাম হরহর করে বলে দিতে পারতাম | কাপড়চোপড়ের হাবভাবে খুবই পশ্চিমা পশ্চিমা একটা ভাব ছিলো |
মোদ্দা কথা আমি যেন সব উপকরণ সাথে নিয়ে পরবাসের মাটিতে এসে পরলাম, এখানে তো আমার খুবই সহজেই মিশে যাবার কথা ছিল, কিন্তু সব কিছুতেই খটকা লাগছে কেন ? যেমন মানুষজনের চলাফেরা আচার ব্যবহার সব কিছুই যেন অপরিচিত, পথে চলতে ফিরতে লক্ষ্য করলাম কেউই আমার মত আচরণ করছে না, কেউ কারুর সাথে কথা তো বলছেই না বরং সবাই যেন একে অপরকে এড়িয়ে চলেছে বিনা প্রয়োজনে ট্রেনে বসে কাউ কারুর ঘরের উপর ভর করে খোশগল্পে মেতে উঠছে না, বাসে উঠে দেখি সেই একি দৃশ্য, যদি প্রয়োজন হয়, মানুষ গুলো খুব অল্প সুরে কথা বলেছে | হকারদের চেঁচামেচিও নেই, স্টেশনে গাড়ী থামছে বটে কিন্তু কুলির দেখা মিলছে না | ট্রেনের ভেতরে সবাই বাবু আবার ট্রেন থেকে নামার সময় সবাই কুলি, রাস্তায় গাড়ী চলছে বটে কিন্তু সারাদিন ঘুরাঘুরির পর একবারের জন্যে হলেও রাস্তায় গাড়ীর হর্নের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না, বরং বাসায় আসার পর আমার এ দেশীয় এক বন্ধু ফোন করে বললো, আমাকে সে আজ বিকলে ফুটপাথের অপর প্রান্তে দেখতে পেরেছে, শুনে তো আমি অবাক , একটু অভিমানের সুরেই বললাম- “তা দেখলে যখন, ডাকলে না কেন ?” বন্ধুটিও বেশ অবাক হয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো – আমি কি রাস্তার উপর লোকজনের ভীরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকবো ? লোকজন কি আমাকে সুস্থ ভাববে ? তারপর তুমি ছিলে রাস্তার ওপারে ” | আমি ভাবলাম কথাটা তো সত্যই যে দেশের মানুষ বিনা প্রয়োজনে একে অপরের নীরবতাকে ভঙ্গ করে না , সেখানে তো আমাকে চিৎকার করে ডাকাডাকিটা নেহায়েত পাগলামি বৈ অন্য কিছু নয় |
এখন আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি আসলে আমি নিজেকে এক অসভ্যতার আবরণে নিজেকে আধুনিক ভাবছিলাম আসলে আমার মাঝে আধুনিকতার লেশ মাত্রও নেই | ভদ্রতা সুলভ যে যে আচরণগুলো আমার মাঝে থাকা উচিত ছিল তার কোনটাই আমার মাঝে বিদ্যমান নাই | তারপর দিন কেটে যেতে থাকলো, সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পারলাম এদেশে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করা হয় ভিন্ন ভাবে যেটা আমি কোনদিন চিন্তা করতে শিখিনি, কারণ আমি যা কিছুই শিখেছি আমার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যা কিছুই শেখানো হয়েছে তা স্কুলের মাস্টারদের বেতের ঘা কিংবা মা বাবার চড় থাপ্পড়ের উপর, যতটুকু পেরেছি মুখস্থ করে স্কুলের খাতায় বমি করে এসেছি কিন্তু যেটাই মুখস্থ করেছি সেটাকে অনুধাবন করার সুযোগ পাই নাই, মার খাবার ভয়ে স্কুলে পাশ করাটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য, বিদ্যাটা অনুধাবন করার জন্যে শিক্ষা নেই নাই | বিষয়টা অনেকটা এ রকম, এখানে শিশুদের গায়ে হাত তোলা তো দুরের কথা জোরে ধমক দেয়াটাই অন্যায়, মানুষ মানুষের গায়ে হাত তোলে না এটাই হচ্ছে এ দেশের প্রচলিত একটি বিশ্বাস ও আইন |
যাকাত ফেতরা দেবার নিয়ম হয়তো এদেশে নাই তমে ১০০ ভাগ মানুষ তার কর পরিশোধ করে থাকে আর তা দিয়ে একটা অভূতপূর্ব সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে যেখানে প্রতিটি মানুষের জন্যে অন্ন, বস্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে | এখন আশা যাক মানুষের অধিকার তা দেখতে কেমন, এখানে নারী কিংবা পুরুষের জন্যে আলাদা কোন আইন নাই, আইন সবার জন্যেই সমান | তবে প্রতিটি মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে উন্নতি করণে কিছু সংযোজিত আইন আছে | যেমন শিশু, প্রতিবন্ধী, নারীদের জন্যে কিছু সংযোজিত আইন আছে যেটা দিয়ে তাদের অধিকারকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায় | সুইডেন আইন ও তার প্রণয়ন নীতি বিশ্বের মানুষের অধিকারের অধিকার আদায়ের একটি নিদর্শন সরূপ যা শুধু শব্দ নয় বরং কর্মেও তার প্রতিফলন ঘটে | আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার জন্য সুইডেনের মানবাধিকার আইন সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্যতা পায়ে থাকে, ইউরোপিয়ান দেশগুলো-তো বটেই |
মানবাধিকার আইন প্রণয়নে মূলত সুইডেনের ভূমিকা পৃথিবীর প্রথম সারির একটি দেশ | সুইডেন শিশুদের জন্য ন্যায়পাল, প্রতিনিধিত্বমূলক শিশুদের উপর তাদের অধিকার ও স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয় নিশ্চিতি করণে এখানে একটি সরকারী সংস্থা চালু আছে | 2008 সালে, সুইডিশ সরকার মানবাধিকার জন্য তার পররাষ্ট্র নীতিতে কাজ করা জন্যে আট বিষয়ে অগ্রাধিকার আইন প্রণয়ন করে,
যথা :- ১ . পৃথিবীর বহু দেশের নাগরিক এখন পর্যন্ত এক নায়ক তন্ত্রের অধীনে বসবাস করছে, সুইডেনর নীতিও হচ্ছে , গণতন্ত্রের পক্ষে জনমত জোরদার ও এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) এর কাজ সমর্থন ও গণতান্ত্রিক রাজ্যের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক স্থাপন | ২. সুইডেনের নীতিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা শক্তিশালী করে তোলা একটি মূল বিষয়, তাই মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি নৈতিক প্রয়োজনীয়তা ও মানুষের অধিকারের জন্য যুদ্ধ একটি ব্যবহারিক হাতিয়ার বলে গণ্য করা হয়ে থাকে | ৩. সুইডেনে মৃত্যুদণ্ডের কার্যকারিতা বিলীন করা হয়েছে . সুইডেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দীর্ঘ মানবাধিকার সঙ্গে বেমানান যে কারণে মৃত্যুদণ্ড অকার্যকর করা হয় | ৪. যুদ্ধ ও যুদ্ধ নির্যাতন বন্ধ করণে সুইডেন সর্বদাই মনোযোগ স্থাপন করে | ৫. জাতিসংঘ রেসুলেসনে যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত করণ, মৃত্যুদণ্ড এবং নির্বিচারে আটক, বিচার-বহির্ভূত এবং অবাধ মৃত্যুদণ্ড রোধে সুইডেনের সমর্থন আছে, আর এই কাজে সুইডেনর ভূমিকা খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হয়ে থাকে | ৬. সুইডেন আইনের শাসন রক্ষা জন্যে জাতিসংঘ, ইউরোপ কাউন্সিল, নিরাপত্তা সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠান গুলির সাথে সর্বদাই সহযোগিতা করে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আইনের শাসন নীতির প্রচার করে | ৭. মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইন রক্ষা করণে সুইডেন বড় এবং ছোট সব রাজ্যের সাথে আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করার লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করে | ৮. সুইডিশ সরকার প্রতিবন্ধী নারী, শিশু ও মানুষের সুচিকিৎসা ও অধিকার নিশ্চিত করণে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে থাকে এবং এইসব কাজে পৃথিবীর যে কোন স্থানে সুইডেনের পূর্ণ সহযোগিতা থাকে | আশা করি এখন আপনার নিশ্চয়ই আমি যে দেশটাতে বসবাস করছি তার একটা চিত্র পেলেন, এখন আপনারাই বলেন কোন ধর্মীয় নীতিতে কি এ ধরনের মানবাধিকারের কথা লেখা আছে? যদি থেকে থাকে দয়া করে আমাকে জানাবেন, আমি বাধিত হবো |