সীতাকুণ্ড সহিংসতায় ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে আমদানি-রফতানিকারকদের। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও জনগণ। শিল্পকারখানার চাকা বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা জাতীয় অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে—রাজনৈতিক কর্মসূচি অবশ্যই অর্থনৈতিক স্বার্থ-বিবেচনায় হতে হবে। অর্থনীতি ধ্বংস করে এমন কর্মকাণ্ড কারোই কল্যাণ বয়ে আনবে না। তদুপরি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক কেন্দ্র করে যে অর্থনৈতিক করিডর গড়ে উঠছে, সেটাও হুমকির মুখে পড়ছে। সহজেই ভাঙচুর ও সহিংস ঘটনার মুখোমুখি হলে বিনিয়োগকারীরা এই করিডরে শিল্প স্থাপনে নিরুত্সাহিত হবেন বলেও মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
সম্প্রতি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড সবমহলের জন্যই ত্রাসের এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এখানকার অব্যাহত সহিংস ও অরাজক অবস্থা চট্টগ্রামসহ সারা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম থেকে পণ্য পরিবহনে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রফতানি-পণ্য ঠিকমতো পৌঁছানো যাচ্ছে না। আবার আমদানিকৃত পণ্য বাজারে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। একই সঙ্গে আমদানিকৃত কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় পৌঁছাতে পারছে না বলে উত্পাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা, যা অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়ায় ভূমিকা রাখছে।
সংশ্লিস্টরা জানান—বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি সামনে রেখে দিনে-রাতে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনার মাধ্যমে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে বলে পরিবহন ব্যবসায়ীদের অভিমত। ফলে বাস ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, কার, মাইক্রোবাসসহ ছোট-বড় যানবাহন মালিকগণ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, একইভাবে পণ্য পরিবহনে এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শুধু সীতাকুণ্ডের সহিংস অবস্থার কারণে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ পরিবহন মালিকরা ভাড়া ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করেছে।
চট্টগ্রাম আন্তজেলা বাস-মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন জানান—গত কয়েক মাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শত কোটি টাকার ক্ষতি সাধন হয়। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ের তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। দেশের আমদানি-রপ্তানির হূিপণ্ড চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড স্থবির হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা আমদানি-পণ্য যেমনভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে পারছে না, একই সাথে রফতানি-পণ্যও চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে পারছে না।
পরিবহন ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন বাদল জানান—রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে মালিকরা সহজে ট্রাক ভাড়া দিতে চায় না। দিলেও ভাংচুর ও জ্বালাও-পোড়াও এবং গন্তব্যে পৌঁছাতে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগার অজুহাত দেখিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া চাচ্ছে।
কাজীর দেউড়ী এলাকার টাইলস ব্যবসায়ী ফারুক জানান—ঢাকায় ৬ হাজার টাকার ভাড়া ১০ হাজার টাকা নিচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে একটি ট্রাক পৌঁছাতে এখন ৩ দিন পর্যন্ত লেগে যায়।
প্রাইম মুডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আকতার হোসেন জানান—মহাসড়কে একদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, একই সাথে পেট্রোল ডিউটির নামে পুলিশ যানবাহন থামিয়ে চেকিংয়ের নামে হয়রানি করছে। ফলে পণ্যগুলো যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না।
উপর্যুপরি হরতাল কর্মসূচি এবং মহাসড়কে ভাংচুর ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের কারণে অনেকে বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করতে পারছে না। শিল্পের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ প্রয়োজনীয় আমদানি-পণ্য নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে না পারায় আমদানি-পণ্যের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে, যথাসময়ে কাঁচামাল না পাওয়ায় উত্পাদিত পণ্য বাজারে যাচ্ছে না। এতে করে উত্পাদনকারী এবং ভোক্তা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সাথে সাথে মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে অনাকাঙ্খিত ঘটনার কারণে ভয়ে বন্দর থেকে অনেকে পণ্য খালাস বন্ধ রেখেছে। কিন্তু বন্দরে অতিরিক্ত সময় অবস্থানের কারণে বন্দর চার্জ বেড়ে যাচ্ছে। এই চার্জের ফলে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের দামও।
এ দিকে, রপ্তানি পণ্যসমূহও যথাসময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে গার্মেন্টস মালিকদের তাদের গার্মেন্টস উড়োজাহাজে করে আমদানিকারকের নিকট পাঠাতে হয়। এর মাধ্যমে বিরাট লোকসানের শিকার হচ্ছেন বলে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে জানানো হয়। আবার অনেকের অর্ডার পর্যন্ত বাতিল হয়ে গেছে।
জানা গেছে—ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে অন্তত ১৫টি প্রাইভেট কন্টেইনার ডিপো থেকে রপ্তানি-পণ্য নিয়ে বন্দরে যেতে পারছে না। একইভাবে এ সব ডিপো থেকে আমদানি-পণ্যগুলোও দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে পারছে না।
বিজিএমইএর প্রাক্তন সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী জানান—মালিকরা গার্মেন্টস চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠাতে সাহস করছেন না। কারণ, এর মধ্যে অনেকের গার্মেন্টস কাভার্ড ভ্যানে আগুনের জন্য পুড়ে গেছে। গার্মেন্টস মালিকগণ বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন। আবার সীতাকুণ্ড মীরসরাই মহাসড়ক-সংলগ্ন বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানাও বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তারা কাঁচামাল যেমন যথাসময়ে পাচ্ছে না। আবার তৈরি পণ্যও বাজারে পাঠাতে পারছে না। সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রপ্তানি-পণ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বন্দরে পৌঁছাতে না পারায় বন্দর থেকে জাহাজগুলো পণ্য ছাড়াই ছেড়ে যেতে হচ্ছে। ফলে জাহাজ-মালিকরাও আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।
গত কয়েক মাস ধরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের আমদানি-রফতানিও অপেক্ষাকৃত কমে গেছে। বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি-রফতানি সাধারণত বেশি হলেও এ বছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে ব্যবসায়ীদের অভিমত। চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এরই মধ্যে শতকরা ৯-১০ ভাগ কমে গেছে। আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ার ফলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। এ বছর (২০১৩-১৪) চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এরই মধ্যে মাস-ভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান। একই সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের আয়েও ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে ভ্যাট, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট কার্যালয় থেকেও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ আশানুরূপ নয় বলে জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের সীতাকুণ্ড-মীরসরাই এলাকায় অরাজকতার ব্যাপারে চট্টগ্রাম চেম্বার গত বুধবার এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় মহাসড়কে নৈরাজ্য বন্ধে ব্যর্থতার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দোষারোপ করা হয়েছে। অরাজক পরিস্থিতির অবসানের জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।