সম্পাদককে সম্পাদক না দেখিলে কে দেখিবে

40

■  মুনতাসীর মামুন

বাংলাদেশের ১৫ জন যশস্বী সম্পাদক একটি বিবৃতি দিয়েছেন সপ্তাহখানেক আগে। এই বিবৃতি নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা নয়, তবে মধ্যবিত্ত যাঁরা রাজনীতি চর্চা করেন বা খোঁজখবর রাখেন তাঁদের মধ্যে খানিকটা প্রতিক্রিয়া তো হয়েছে বটেই। এর প্রধান কারণ, ওই ১৫ জন যেসব সংবাদপত্রের সম্পাদক ও মালিক তাদের প্রচারসংখ্যা গরিষ্ঠ। একত্রে তাঁরা ছাপা মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করেন। এবং যেহেতু সংবাদপত্র এখন স্বাধীন তাঁরা ইচ্ছে করলে বিদ্যমান সরকারের যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারেন। তাঁরা যে শক্তিশালী এটি আবার সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য তাঁরা একত্রিত হয়েছেন এবং সিভিল সমাজকে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন, কোন রাজনীতিবিদ, সুশীল বা সিভিল সমাজের কেউ, কোন সাংবাদিক যেন তাঁদের দিকে আঙ্গুল উঁচানোর স্পর্ধা না দেখান।

চারটি পত্রিকার সম্পাদক/মালিক তাঁদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। এই চারটি পত্রিকা কোন না কোন সময় গরিষ্ঠ পত্রিকা ছিল। সেগুলো হলো ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, আমাদের সময় ও ভোরের কাগজ। বুদ্ধিজীবী সমাজও আতঙ্কিত। কেননা ১৫ জনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে খুব কম বুদ্ধিজীবীই আগ্রহ দেখিয়েছেন। সরকার সমর্থিত বর্তমান ও প্রাক্তন উপাচার্যদের কয়েকজন, বয়োজ্যেষ্ঠ অত্যন্ত খ্যাত, অনেকে বলেছেন, কাজটি ১৫ জন অন্যায় করেছেন বটে কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে লড়াই করার ঝামেলায় পড়তে চাই না। তাঁরা যে শক্তি প্রদর্শন করতে চেয়েছেন এবং সবাইকে পেশীশক্তি দেখিয়ে হুমকির ইঙ্গিত করেছেন তার উদাহরণ তাঁরা যার সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন তিনিও এ দেশে পরিচিত একজন পেশীজীবী হিসেবে।

একটি প্রশ্ন অনেকেই উত্থাপন করেছেন বিভিন্ন আলোচনায় যে, হঠাৎ ১৫ জন ঐক্যবদ্ধ হলেন কেন? কারণ এদের একেক জনের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। বয়েস একেক রকম। এদের মধ্যে পাকিস্তান সমর্থক আছেন, হেজাবীদের [হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি] সমর্থকও আছেন, মাহমুদুর রহমানের মুখোশ উন্মোচন করেছেন এমন সম্পাদক যেমন আছেন বামঘেঁষা সেক্যুলার এমনকি আওয়ামী লীগার হিসেবে পরিচিত সম্পাদকও আছেন। এঁদের অধিকাংশ আমাদের অনেকের, আমারও পরিচিত, বন্ধু। আমি অন্তত দীর্ঘদিন এদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে বলতে পারি, দু-একজন ছাড়া এঁরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সমালোচক ও অপছন্দের। সুতরাং কোন উদ্দেশ্য ছাড়া তাঁরা একত্রিত হয়েছেন তা কেউই বিশ্বাস করছে না। আমরা, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মতলববাজ, মাত্রায় কম-বেশি। আমাকেও এ দলে ফেললে একেবারে ক্রুদ্ধ হতে পারব না। আমরা দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী মতলবে ঠাসা মাথা নিয়ে ঘোরাফেরা করি বা জেগে থাকি। সুতরাং আমাদের অনেকের প্রশ্ন মতলবটা কী?

১৫ জন প্রতিবাদী সম্পাদককে নিয়ে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে যার মধ্যে স্বদেশ রায়ের লেখাটি অনেকেরই ভাল লেগেছে যুক্তির কারণে। তিনি সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে রাজি নন, বিশেষ করে মাহফুজ আনামকে। তিনি লিখেছেন
‘এখানে সকলেই যে মাহমুদুর রহমানের কীর্তিকে জায়েজ করার জন্য এ কাজ করেছেন এটা সাংবাদিক হিসেবে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কষ্ট। যেমন যে পত্রিকা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে একটি সংখ্যায় হাসনাত আবদুল হাই ও অদিতি ফাল্গুনীকে দিয়ে নোংরা গল্প লিখিয়েছে। যাদের জনমত জরিপে হেফাজতীদের উত্থান, জামায়াতের তা-ব, বিরোধী দলের কর্মীদের দ্বারা হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙ্গা এমনকি হিন্দুদের অস্ত্রের মুখে মিছিলে নিয়ে তাদের দিয়ে নারায়ে তকবির/আল্লাহু আকবার বলানো এসব নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। এসব পত্রিকার কর্ণধাররা মাহমুদুর রহমানকে সমর্থন করবেন। তাছাড়া যাঁরা একাত্তরে রাজাকার ছিলেন পাকিস্তান বেতারে ‘প্লেন ট্রুথ’ লিখতেন। বঙ্গবন্ধু এসে তাঁকে প্রেস সেক্রেটারি করার পর শুধু প্লেন ট্রুথ লেখা নয়, তিনি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর মনোরঞ্জনের জন্য আর কী কী করেছিলেন সেগুলো দৈনিক গণকণ্ঠে ছাপা হলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁরা আজ যতই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বা সম্পাদক হন না কেন, তাঁরা কিন্তু শেষ বিচারে মাহমুদুর রহমানের পক্ষেই থাকবেন।’ [জনকণ্ঠ, ২৩.৫.১৩] আবার দেখুন, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রথম দিন থেকেই অযথা প্রথম আলোর মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণে মত্ত ছিলেন। তাঁরা যে সঠিক কাজটি করেননি সেটি প্রেস কাউন্সিলের রায়ে বলা হয়েছে এবং বিষয়টি কোন পত্রিকার জন্য শুভও নয়। কিন্তু ১৫ জনে প্রথম আলোর মতিউর রহমান যেমন আছেন, কালের কণ্ঠের ইমদাদুল হক মিলনও আছেন। তবে অধিকাংশ বিস্মিত ও দুঃখিত হয়েছেন বিশেষ করে সমকালের গোলাম সারওয়ার ও সংবাদের মুনীরুজ্জামানের স্বাক্ষর দেখে। এঁরা এবং এঁদের মালিকরা আওয়ামী লীগের বিপক্ষের মানুষ নন। বাকি ১৩ জন কম-বেশি আওয়ামী লীগের বিপক্ষের। বিবৃতিটা এক অর্থে বর্তমান জোট সরকারের বিরুদ্ধেও।

এ পরিপ্রেক্ষিতে দুটো বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। আমাদের অনেকের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বক্তৃতা, আলাপচারিতা, লেখায় কোন না কোনভাবে পুঁজি ও শ্রেণীর কথা তুলতেন। আমরা অনেকে তাঁকে নিয়ে এ জন্য ঠাট্টা করতাম। আজ তো এসব শব্দ আলাপচারিতা থেকে উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু এই ১৫ জনের বিবৃতি দেখে, স্যারের কথা মনে হলো। পুঁজি, শ্রেণী, গোষ্ঠীস্বার্থ একেবারে উধাও হয়ে যায়নি, সমাজতন্ত্র না থাকলেও। কারণ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোই এসবের বিরুদ্ধে ছিল। একজন ব্যক্তির সঙ্গে একজন ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, কলহ থাকতে পারে, সাপে নেউলে সম্পর্কও থাকতে পারে কিন্তু দিনান্তে শ্রেণী, পুঁজির, গোষ্ঠীস্বার্থের প্রশ্নে তাঁরা এক থাকবে। কেন, সে প্রসঙ্গে আসছি পরে।
পত্রিকার মালিকানা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর প্রধান মালিক, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও সংবাদের মালিকরা পুরনো পুঁজিপতি। ওইসব পুঁজিপতি আবার বর্তমান আগ্রাসী পুঁজিপতিদের মতো নন। আমার জানা ভুলও হতে পারে কিন্তু আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, বাকি পত্রিকার মালিকদের উত্থান বিএনপি আমলে। তাঁরা বিকশিত হয়ে ওঠেন এরশাদ আমলে। এঁদের একটি অংশও ঋণখেলাপী। তাঁরা মূলত আওয়ামী লীগবিরোধী, মাঝে মাঝে জনচাপে আওয়ামী লীগ হন। তাঁদের অনেকে প্রগতিশীলতার কথা বলেন, কিন্তু প্রগতিশীলতা যখন বিপন্ন হয়, তখন প্রগতির পক্ষে থাকেন না। স্বদেশ রায়ের লেখায় তাঁর ইঙ্গিত আছে। ২০০০ সালে তাঁরা তুমুল আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় মেতে ওঠেন এবং তৃপ্তি বোধ করেন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যাওয়ায়। ঠিক নির্বাচনের আগে তাঁদের আওয়ামীবিরোধী প্রচারণা তুঙ্গে ওঠে, এভাবে তাঁরা পূর্বের স্মৃতি অবলেপন করেন। তাঁরা কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপারে পারতপক্ষে তীব্র মন্তব্য করেন না। করলেও পরে এমন কোন মন্তব্য করেন যাতে ফলটা বিএনপির পক্ষে যায়। বিদ্যুতায়িত মাধ্যমও একই কাজ করছে। একটি উদাহরণ দিই। বিশ্বজিৎ হত্যার পর টানা এক সপ্তাহ, তারপর প্রতি সপ্তাহে একদিন-দু’দিন করে সেই করুণ দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি যখন যাত্রীভর্তি বাস-সিএনজি পোড়াচ্ছে, পুলিশকে পিটিয়ে জামায়াতীরা মেরে ফেলছে বা কোরান পোড়াচ্ছে হেজাবীরা, সেগুলো কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে দেখানো হয়নি। এর কারণ তাঁরা কখনও ব্যাখ্যা করবেন না। সৎ সাংবাদিকতার নামে এগুলো করা হচ্ছে। বিভিন্ন টক শোতে মুক্তিযুদ্ধ সঠিক হয়েছিল কি না, যুদ্ধাপরাধ বিচার ঠিক হচ্ছে কি না এসব নিয়ে প্রতিদিন বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এবং এসব প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন তাঁদের বেশি সময় দেয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, হত্যা, গুম নিয়ে বিতর্ক হলে সঞ্চালক বলে ওঠেন, পুরনো কথাবার্তা তুলে লাভ নেই। বর্তমান বুঝতে হলে পুরনো সময় ভিত্তি হিসেবে থাকবে না এ মন্তব্য বালখিল্যতা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্নেহধন্য অনেককে চাহিবামাত্র টিভি লাইসেন্স, এফএম রেডিও লাইসেন্স দিয়েছেন। তাঁরা সেগুলো বিএনপি-জামায়াতীদের কাছে অর্পণ করেছেন। যাঁরা করেননি তাঁরাও অন্য চ্যানেলগুলোর মালিকের মতো ব্যবহার করছেন। প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য অনেক সম্পাদক/মালিক গত চার বছরে অনেক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন বিনিময়ে তাঁদের ছুরির ফলার সম্মুখীন হচ্ছেন। দোষ তাঁরই। সুপাত্রে তিনি নিয়ত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত খুবই কম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কন্যার একটিই তফাত বঙ্গবন্ধু নিজের চারদিকে রাখতেন যোগ্যদের।

তবে খালি পুঁজি বা শ্রেণী বা গোষ্ঠীর কথাই নয়। ঐতিহাসিকভাবে এ দেশে ডানপন্থাই গরিষ্ঠ। মধ্য বা মধ্য বাম সংখ্যালঘিষ্ঠ। বামের কোন স্থানই নেই। আওয়ামী লীগকে মধ্য বা ১৪ দলীয় জোটকে মধ্য বাম বললেও তাদের মধ্য ডানের ঝোঁক প্রবল। আমরা যতই প্রগতিশীলতার ভাব করি না কেন, আমাদের অধিকাংশের পরানের গহীন গভীরে হেজাবী বা হেফাজতী বিড়ালটি ঘাপটি মেরে বসে আসে। যখন অন্তিমে পক্ষ বেছে নেয়ার কথা ওঠে, তখন থলের বিড়ালটি বেরিয়ে আসে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যাবে ১৫ সম্পাদক যা করেছেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

প্রথমে দেখা যাক ১৫ সম্পাদক কী বলতে চেয়েছেন।
বিবৃতিতে আমার দেশের ছাপাখানায় তালা দিয়ে পত্রিকা ছাপা বন্ধ করা, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পর নির্যাতনের অভিযোগ, বিকল্প ব্যবস্থায় ছাপতে না দিয়ে আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের এবং বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন সম্পাদকরা। তাঁরা মনে করেন, সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর আশঙ্কাজনক হুমকি।
বিবৃতিতে সম্পাদকরা বলেন, মাহমুদুর রহমানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেফতার করে আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় তালা লাগিয়ে দেয়া এবং কোন কারণ না দেখিয়ে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে অনেক সাংবাদিককে বেকারত্বের অন্ধকারে নিক্ষেপ করা কোন নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে অনুকূল নয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, একজন সম্পাদককে গ্রেফতার, পত্রিকার প্রকাশনা ব্যাহত ও দুটি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। একই সঙ্গে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত ও বিবেচিত হচ্ছে।

বিবৃতিতে সই করেন ইন্ডিপেনডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন, নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, নিউ নেশন সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম ও যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলম [প্রথম আলো, ১৯.৫.১৩]

সঠিক তথ্যের স্বার্থে বিবৃতি ও বিবৃতিদাতাদের নামগুলো উদ্ধৃত করলাম। এখানে যা উল্লেখ করা হয়েছে তার বাইরেও একটি কারণ আছে যা উল্লেখ করব। তবে তার একটি পটভূমি দেয়া প্রয়োজন।

বিবৃতিটি যেদিন ছাপা হয় সেদিন খুলনায় এক সভা শেষ করে আমি, শাহরিয়ার কবির, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও ডা. কামরুল ফিরছিলাম গাড়ি করে। পথে কয়েকটি পত্রিকা কিনলাম। সংবাদটি চারজনই পড়লাম। এবং চারজনের কাছেই তা অবিশ্বাস্য মনে হলো। না, ক্ষোভের থেকেও প্রথম বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনাটা বড় হয়ে দেখা দিল। বাংলাদেশ কি তাহলে এমন দেশে পরিণত হলো যেখানে বিশ্বাসযোগ্য বা শ্রদ্ধেয় কোন ব্যক্তি রইলেন না? আরও বিস্মিত হলাম এ কারণে যে, তাদের একটি অংশ হেজাবীদের ধ্বংসাত্মক কাজের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। মাহফুজ আনামকে ফোন করলেন বাচ্চু এর কারণ জিজ্ঞেস করতে। বাচ্চুর কথার মূল ছিল ‘এট টু ব্রুটাস?’ মাহফুজ আনাম তাঁকে জানিয়েছিলেন দু’টি কারণে বিবৃতি দিয়েছেন, এক. সরকার মাহমুদুরকে আটক করেছে কিন্তু কোন মামলা দেয়নি। দুই. প্রফেশনাল। মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে আমি ক্ষুব্ধভাবেই কথা বললাম। আমরা তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। এবং সবারই মনে হয়েছিল, তিনি কিসের আশ্বাসে এ কাজটি করেছিলেন? মাহফুজ আনামও স্বাক্ষর করতে পারেন, কিন্তু মুনীরুজ্জামান করবেন না। সংবাদ এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ সেটি এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মুনীরুজ্জামানও অত্যন্ত শীতল গলায় জানালেন, বিষয়টি প্রফেশনাল। ডা. কামরুল ছাড়া আমরা তিনজন ১৯৬৯-৭০ থেকে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বা আছি। যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন তাঁদের একটা বড় অংশ তখন স্কুল-কলেজের ছাত্র। প্রফেশনালিজমের কথা বললে তখন এই প্রফেশন নিয়েও কিছু বলতে হয়।

ওঁরা ১৫ জন বলেছেন, ‘সরকারের পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর আশঙ্কাজনক হুমকি।’

সরকার দু’টি চ্যানেল ও একটি পত্রিকা ‘বন্ধ’ করে দেয়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের হুমকি? গত সাড়ে চার বছরে যে রকম অবাধ স্বাধীনতা চ্যানেল ও পত্রিকা পেয়েছে তা আগের দু’টি আমলে ছিল? স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি এখন সারাবিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। একজন কতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন? রাষ্ট্রের নিরাপত্তার চেয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নটি বড় কি না, যুক্তরাষ্ট্র যেখানে অবাধ স্বাধীনতা আছে বলে আমাদের ধারণা, সেখানেও এখন এ প্রশ্নটি উঠেছে। এবং একটি বিষয়ে সবাই মতৈক্যে পৌঁছার চেষ্টা করছে যে, উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তবে নিরাপত্তা অগ্রাধিকার পাওয়র দাবি রাখে।

১৫ জনের বক্তব্যের তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
১. ‘মিডিয়ার ওপর বর্তমান সরকারের এই পদক্ষেপ সাংবাদিকতা পেশার ওপর অশুভ হস্তক্ষেপ।’
কেন অশুভ হস্তক্ষেপ তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার অশুভ হবে কেন? হাসানুল হক ইনু জানিয়েছেন, তাঁর অফিসে হ্যাকিংয়ের আলামত পাওয়া গেছে। এক পত্রিকায় জানলাম, মাহফুজ আনাম নাকি এরও প্রতিবাদ করেছেন এ বলে যে, সরকারই শুধু জানে তা ঠিক নয়। উল্টো বলা যায়, সম্পাদকরাই বাংলাদেশে একমাত্র বুঝদার লোক এই দাবিও ভয়ঙ্কর। মাহমুদুর রহমান তিনটি মাস যা করেছেন, পৃথিবীতে আর কোন সম্পাদক তা করেছেন কি না সন্দেহ। ব্রিটেনে ফোন হ্যাকিংয়ের জন্য ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নিষিদ্ধ করলে কোন সম্পাদক তার সমর্থনে দাঁড়ায়নি। পত্রিকাটি ১০০ বছরের শুধু পুরনোই নয়, জনপ্রিয়ও বটে।

অন্যদিকটি দেখা যাক। সম্পাদকরা সাংবাদিকতা পেশার ওপর কতটা গুরুত্ব দেন? একটি সংবাদপত্র শুধু সম্পাদকের বা মালিকের মেজাজমর্জির ওপর চলতে পারে না। সাংবাদিকদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে তা চালিত হয়। কিন্তু এখানে সাংবাদিকদের মতামত প্রধান নয়, মালিক/সম্পাদকের মতই পত্রিকার মত। ১৫ জন কি স্বাক্ষর করার আগে তাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়েছিলেন? করেননি।

এসব বিষয়ে সম্পাদকরা একক সিদ্ধান্ত নেন। ১৫ জন সম্পাদক সম্পাদিত ১৫টি পত্রিকার সাংবাদিকদের একটি অংশ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ, সম্পাদকরা তাঁদের শ্রমে গড়ে ওঠা পত্রিকা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছেন। অনেকে শুধু চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খুলছেন না। সম্পাদকরা গণতন্ত্র সম্পর্কে যত ছবকই দিন না কেন নিজ নিজ পত্রিকায় কিন্তু সেই গণতন্ত্র অচল।
: দৈনিক জনকণ্ঠ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here