
যৌথ বাহিনীর অপারেশন থান্ডারবোল্টের পর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্ট। ছবি : সাবের হোসেন চৌধুরীর টুইট থেকে
চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ঠাসা প্রায় ১২ ঘণ্টার জিম্মি সংকটের অবসান ঘটেছে মাত্র ১৩ মিনিটে। কিন্তু এতে হারাতে হয়েছে ২০ জনকে। যার মধ্যে ১৭ জনই বিদেশি নাগরিক। এর আগেই প্রাণ দিয়েছেন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা। আহত হয়েছেন পুলিশের অন্তত ৪০ সদস্য। রক্তাক্ত এই ঘটনায় হামলাকারী ছয় অস্ত্রধারী নিহত হয়েছে। আটক হয়েছে একজন।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারি নামের একটি রেস্টুরেন্টে শুক্রবার রাত সোয়া ৮টার দিকে গুলি করতে করতে ঢুকে পড়ে সাত অস্ত্রধারী। রেস্টুরেন্টটিতে থাকা দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে ফেলে তারা। রাজধানীর কূটনীতিক এলাকায় শুরু হয় এক বিভীষিকাময় ও রুদ্ধশ্বাস ঘটনার। এর আগে দেশে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। পরদিন গতকাল শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একটি প্যারা কমান্ডো দল ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শুরু করে। ১৩ মিনিটের মধ্যে অস্ত্রধারীদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয় তিন বিদেশি নাগরিকসহ ১৩ জনকে। সকাল সাড়ে ৮টায় অভিযান শেষ হওয়ার পর অবসান ঘটে ভয়াবহ এই জিম্মি সংকটের। তবে নিহতদের স্বজনরা বলছে, ঘটনার পরপর দ্রুত অভিযান শুরু করলে এমন মর্মান্তিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় আন্তঃবাহিনী সংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সংবাদ সম্মেলন করে জিম্মি সংকট অবসান এবং অভিযানের বিষয়টি জানায়। ঢাকা সেনানিবাসের সেনা সদরের অফিসার্স মেসে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অভিযানের মাধ্যমে আমরা তিনজন বিদেশিসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হই। এদের মধ্যে দুজন শ্রীলঙ্কান ও একজন জাপানি নাগরিক। অভিযানে সাতজন সন্ত্রাসীর মধ্যে ছয়জন নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। রেস্টুরেন্টে তল্লাশিকালে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, যাদের ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র গতকাল রাতে নিশ্চিত করেছে, নিহত বিদেশিদের মধ্যে ইতালির ৯ জন, জাপানের সাতজন ও ভারতের একজন নাগরিক রয়েছেন। এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে তিন বাংলাদেশি নাগরিকও রয়েছেন।
ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত রাতে নিশ্চিত করেছে, ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় তাদের ৯ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন মারকো তনদাট, ভিনচেজু ডেলেস্ত্র, মারিয়া রিবলি, নাদিয়া বেনিদেত্তি, আদেয়া পলিজি, ক্লদিও ক্যাপেলি, ক্রিস্তিয়ান রসি, ক্লদিও মারিয়া দানতোনা ও সিমোনা মন্তি।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ জানিয়েছেন, নিহত ভারতীয় তরুণীর নাম তারিশি জৈন। আইএসপিআর গতকাল রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নিহত তিন বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করেনি। তবে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, নিহত তিন বাংলাদেশি হলো—ফারাজ আইয়াজ হোসেন, ইশরাত আখন্দ ও অবিন্তা কবীর। ফারাজ ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি। ইশরাত ঢাকার একটি আর্ট গ্যালারির সাবেক প্রধান এবং অবিন্তা সুপার স্টোর ল্যাভেন্ডারের মালিক মনজুর মোরশেদের নাতনী।
পুলিশ জানিয়েছে, তারা ধারণা করছে নিহত হামলকারীদের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক।
নজিরবিহীন এই ঘটনায় গতকাল রাত পৌনে ৮টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। সন্ত্রাসীদের সমূলে নির্মূল করে বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করবই।’ প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, শুক্রবার জিম্মি সংকট শুরুর পরপরই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দেয় সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম তাদের টুইট পেইজে হামলার দায় স্বীকার করে টুইট করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেছেন, হামলায় আইএসের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
একই দিন ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় একটি মঠের সেবায়েত এবং আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আওয়ামী লীগের এক নেতাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডের দায়ও আইএস স্বীকার করেছে বলে খবর দিয়েছে সাইট ইন্টেলিজেন্স।
আরেকটি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে হামলার ঘোষণা দিয়ে টুইট করেছিল।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একাধিক সূত্র জানায়, হামলাকারীরা জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সমন্বিত একটি দল বলে ধারণা করা হচ্ছে। রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে যেসব একে-২২ রাইফেল, পিস্তল ও অবিস্ফোরিত ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) উদ্ধার করা হয় সেগুলোর সঙ্গে জেএমবির ব্যবহৃত অস্ত্রের মিল আছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় জেএমবি আস্তানা থেকে একই রকম অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা বলছেন, সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আলামত পরীক্ষা করে হামলাকারীদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে।
অভিযান শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘অভিযান সফল হয়েছে। ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছি। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বেশ কিছু লোক হতাহত হয়েছে।’ দেশের মানুষকে বেকায়দায় ফেলতেই এ ধরনের হামলা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আইজিপি।
নজিরবিহীন জিম্মি সংকটের শুরু : গত শুক্রবার রাত সোয়া ৮টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের একটি ডুপ্লেক্স বাড়িতে ‘ও কিচেন’ ও ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ নামের রেস্টুরেন্টে ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঢুকে পড়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বন্দুকধারীদের হাতে রামদা ও তলোয়ারও ছিল। তারা রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভেতরের সবাইকে জিম্মি করে ফেলে।
হলি আর্টিজান বেকারির সুপারভাইজার সুমন রেজা সাংবাদিকদের জানান, তিনি ও রেস্টুরেন্টের আরেকজন কর্মী ইতালির নাগরিক দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। তিনি জানান, জিম্মি ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ২০ জন বিদেশি।
সুমন আরো বলেন, তিনি ছাদে ছিলেন। রাত সোয়া ৮টার দিকে প্রথমে দুজন, একটু পর আরো ছয় যুবক রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢোকে। সবার হাতে অস্ত্র ছিল। তাদের বয়স ২০ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। তাদের কারো কারো পিঠে ব্যাগ ছিল। রাত ১০টা থেকে সোয়া ১০টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রেস্টুরেন্টে ঢুকতে চেষ্টা করলে ভেতর থেকে অস্ত্রধারীরা গুলি করে ও বোমা ছোড়ে। এতে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন। তিনি বলেন, ‘ওরা যখন বোমা মারছিল, তখন পুরো বিল্ডিং কাঁপছিল। ওরা একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে।’
একটি ডুপ্লেক্স বাড়িতে ব্যবসায়ী শাহাদাত মেহেদী ‘ও কিচেন’ নামের রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করেন। এর পাশেই তিনি হলি আর্টিজান বেকারি নামের এই রেস্টুরেন্ট করেছেন। রেস্টুরেন্টটি স্প্যানিশ খাবার পরিবেশন করে।
ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সোয়াত সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তাঁরা রেস্টুরেন্টের আশপাশসহ প্রায় পুরো এলাকা ঘিরে রাখেন। আশপাশে প্রায় চার কিলোমিটার এলাকার সব সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রাত ১১টা ২০ মিনিটে ঘটনাস্থল থেকে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি রেস্টুরেন্টে অস্ত্রধারীরা ঢুকে লোকজনকে জিম্মি করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভেতরে যেসব বিপথগামী আছে আমরা তাদের সমস্যা শুনতে চাই। তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ ওই সময় তিনি দেশের স্বার্থে টেলিভিশনগুলোকে সরাসরি ঘটনাটি সম্প্রচার না করার অনুরোধ জানান। এরপর টেলিভিশনগুলো সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়।
গুলশান এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রাত পৌনে ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে তাঁরা অর্ধশতাধিক গুলির শব্দ শুনেছেন। এতে গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
জিম্মি সংকটের প্রথম পর্যায়ে পুলিশ উদ্ধার অভিযান চালাতে গেলে রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে সন্ত্রাসীরা গুলি ও বোমা ছোড়ে। এতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান নিহত হন। আহত হন অন্তত ৪০ পুলিশ সদস্য। তাঁদের মধ্যে ৩৬ জন গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল এবং দুজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
রাত প্রায় ২টার দিকে যৌথ অভিযানের প্রস্তুতি নেয় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াতসহ অন্যান্য বাহিনী। চারটি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) ঘটনাস্থলে যায়। নৌবাহিনীর একটি দলকেও সেখানে আনা হয়। ঘটনাস্থলের পাশে বিজেএনসি ভবনে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা করার জন্য বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন চারজন কর্মকর্তাও ছিলেন। রাত পৌনে ৩টার দিকে পুলিশ ও র্যাব প্রধান গণভবনে যান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার জন্য। এরপরই উদ্ধার অভিযানে ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের।
অপারেশন থান্ডারবোল্ট : সেনাবাহিনীর একটি প্যারা কমান্ডো দলকে সিলেট থেকে জরুরিভাবে বিমানে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস থেকেও আসে দুটি কমান্ডো দল। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু করা হয় উদ্ধার অভিযান, যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন থান্ডারবোল্ট। প্রথমে ৯টি এপিসি প্রবেশ করে ৭৯ নম্বর সড়কে। এর পেছন পেছন কমান্ডো দল অগ্রসর হয়।
অভিযানসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কমান্ডো দলটি হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছার পর দুটি এপিসি সজোরে ধাক্কা দেয় রেস্টুরেন্টের দেয়ালে। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে থাকা জঙ্গিরা প্রথমে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। অপ্রতিরোধ্য এপিসি নিচ তলায় গিয়ে অস্ত্রধারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। সন্ত্রাসীরাও পাল্টা গুলি করে। এ সময় জিম্মি থাকা লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। সেনা সদস্যরা তাদের ভয় না পেতে বারবার অনুরোধ করেন। ১০-১২ জন সেনা কমান্ডো রেস্টুরেন্টের নিচ ও দ্বিতীয় তলা ঘিরে রাখেন। আর কিছু সদস্য জিম্মিদের একটি কক্ষে সরিয়ে নেন। অভিযানে অংশ নেওয়া আরেকটি দল ভাগ হয়ে দ্বিতীয় তলায় চলে চায়।
অভিযানের সময় গুলি, গ্রেনেড ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়। আতঙ্ক দেখা দেয় লোকজনের মাঝে। সকাল সাড়ে ৮টায় শেষ হয় অপারেশন থান্ডারবোল্ট। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের।
অভিযানে অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা বলেন, রেস্টুরেন্টের নিচ তলায় কয়েকজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। তিন সন্ত্রাসী গ্রেনেড ও পিস্তল হাতে কমান্ডোদলকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তাদের ধরাশায়ী করেন কমান্ডোরা।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, সন্ত্রাসীরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে মনে হয়েছে। তারা যেভাবে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে রেখেছিল তাতে মনে হয়েছে তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কানেকশন রয়েছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, তিনি ভবনের ছাদ থেকে টেলিস্কোপ লাগানো স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখতে পান। গুলি ছোড়া হয় সাঁজোয়া যান থেকেও। পরে সেনা সাঁজোয়া যান হলি আর্টিজানের দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢোকে। ওই কম্পাউন্ডের বাইরের দিকে থাকা পিত্জা কর্নার এ সময় গুঁড়িয়ে যায়।
দুপুর দেড়টার দিকে অপারেশনে অংশ নিতে আসা ৯টি এপিসি গুলশান এলাকা ত্যাগ করে। তার পাশাপাশি চলে যান অপারেশন থান্ডারবোল্টে অংশ নেওয়া কমান্ডো সেনারাও। এরপর রাস্তার একপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দের নেতৃত্বে সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারপর ১৩টি অ্যাম্বুল্যান্সে রেস্টুরেন্টের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়।
লাশ সিএমএইচ-এ : গতকাল বিকেল ৪টার দিকে রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে নিহতদের লাশ বের করে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হয়। এরপর ১৩টি অ্যাম্বুল্যান্সে করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। সেখানেই ময়নাতদন্ত করা হবে। লাশ নেওয়ার পরপরই ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের এডিসি মশিউর রহমান উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘জায়গাটি ঘিরে রাখা হবে।’
এর আগে শুক্রবার রাতে উদ্ধার অভিযানের প্রথম পর্যায়ে নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার লাশ ময়নাতদন্ত হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে তাঁদের জানাজা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রচলিত নিয়ম মেনেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হবে। তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রভোস্ট মার্শালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। তাঁর মুঠোফোন নম্বর-০১৭৬৯০১২৫২৪।
লাশ নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন শাখার সদস্যরা আলামত সংগ্রহের জন্য রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করেন। তা ছাড়া রেস্টুরেন্টের চারপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে।
২০ জনকেই গলা কেটে হত্যা করা হয় : অভিযানে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, শুক্রবার রাতেই তিন নারীসহ ২০ জনকে গলা কেটে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। তাদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি, তিনজন বাংলাদেশি নাগরিক বলে নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বড় চাপাতি ও তলোয়ার ব্যবহার করা হয়েছে।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, বিদেশিদের টার্গেট করে সন্ত্রাসীরা রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার দুই নাগরিককে হত্যা করেনি জঙ্গিরা : জঙ্গি হামলার ঘটনায় শ্রীলঙ্কার দুই নাগরিক জিম্মি ছিলেন। তাঁদের জীবিত উদ্ধার করে সিএমএইচএ ভর্তি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের বাংলাদেশিদের মতো মনে হওয়ায় জঙ্গিরা তাঁদের হত্যা করেনি বলে তাঁরা গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন। এক টুইটার বার্তায় শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রও একই কথা বলেছেন।
অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার জঙ্গিদের : বিশেষ অভিযানের পর সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত যেসব আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো খুবই উন্নতমানের। র্যাবের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, রেস্টুরেন্টটি দখল করার পর কয়েক সন্ত্রাসী ফটকের সামনে অবস্থান নেয়। খবর পেয়ে গুলশান থানাসহ আশপাশের থানাগুলো থেকে পুলিশ ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। গিয়েই তারা রেস্টুরেন্ট কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ে। পুলিশ বুঝতেই পারেনি সন্ত্রাসীরা অত্যাধুনিক অস্ত্র, বোমা ও বিস্ফোরক নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিল। তিনি বলেন, অপারেশন থান্ডারবোল্টের সময় ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় জঙ্গিদের ব্যবহার করা চারটি পিস্তল, একটি ফোল্ডেড বাট একে ২২ রাইফেল, চারটি অবিস্ফোরিত আইইডি, একটি ওয়াকিটকি সেট ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র।
জঙ্গিদের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা : গত শুক্রবার রাতে হামলার পর আইএস ও আনসার ইসলাম নামে ঘটনার দায় স্বীকার করা হয়। আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তা দিয়ে ২০ জন বিদেশিকে হত্যার কথা জানানো হয়। গতকাল নিহতের সংখ্যা মিলে যাওয়ায় এসব হামলাকারীর আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
তবে পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক বলেন, হামলাকারীরা দেশি জঙ্গি। তারা পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিল। পুলিশ তাদের খুঁজছিল। রাজারবাগে দুই পুলিশ কর্মকর্তার জানাজা শেষে আইজিপি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশে ধারাবাহিক নাশকতার যে নীলনকশা তারই অংশ হিসেবে গুলশানে এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। জঙ্গিরা ছক এঁকেই হামলায় অংশ নিয়েছিল।
ডিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হামলাকারীদের ব্যবহৃত অস্ত্রের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও বগুড়া থেকে উদ্ধার করা জেএমবির অস্ত্রের সঙ্গে মিল আছে। গতকাল উদ্ধার অভিযানের পর অজ্ঞাতপরিচয় যেসব ব্যক্তিকে পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে কয়েকজনকে সন্দেহের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সম্পৃক্ততা খোঁজা হচ্ছে।
গুলশান এলাকা থমথমে : গতকাল বিকেলে গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের উদ্ধার অভিযানের সামগ্রিক কাজ শেষ হলেও ওই সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। গুলশানের ওই সড়ক ও আশপাশের সড়কে মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়নি। গোটা এলাকায় পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন রয়েছে। থমথমে পরিস্থিতি ছিল গোটা এলাকায়।