Home
ফিচার ‘রাজারবাগসহ সারা শহর কেঁপে উঠলো গুলির শব্দে’
ফকির আলমগীর

বাঙালি জাতির গৌরবের মাস ডিসেম্বর। লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই মানচিত্রে আমাদের প্রণম্য মুক্তিযোদ্ধা তারকাদের সংখ্যাও কম নয়। প্রতিবছর বিজয়ের মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে শিল্পী-কুশলীদের লেখা বা স্মৃতিগদ্য ছেপে থাকি। এ বছরে পুরো মাসজুড়ে তারকাদের বয়ানে থাকবে তাদের দেখা যুদ্ধকালীন খণ্ডচিত্র। এ নিয়েই পুরো ডিসেম্বরের আয়োজন ‘সেই সময়’। আজ লিখেছেন প্রখ্যাত গণসঙ্গীতশিল্পী
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমরা সারা শহরে গণসঙ্গীতের মাধ্যমে সংগ্রামী জনতার সঙ্গে রাখিবন্ধন করেছিলাম। আমার এখনও মনে আছে, ২৩ মার্চে ডিআইটিতে অবস্থিত টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে আমরা গণশিল্পীগোষ্ঠির ব্যানারে মুস্তাফিজুর রহমানের প্রযোজনায় এক ঘণ্টার একটি প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি। সেই মুহূর্তে অনুষ্ঠানটি বেশ সাড়া জাগায়। তার একদিন পর ২৫ মার্চ কালো রাত। পিলখানা, রাজারবাগসহ সারা শহর কেঁপে উঠলো গুলির শব্দে। চারদিকে চলছিল নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। তখন বাসায় আমি একা ছিলাম, তাই দু’রাত পর এলাকার অন্যান্যের সঙ্গে খিলগাঁয়ের অদূরে মেরাদিয়া গ্রামে পালিয়ে ছিলাম। তারপর ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হলে আমি বুড়িগঙ্গা পার হয়ে বিক্রমপুরের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধায়, আমার নিজ গ্রামে। এর মধ্যে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমার বন্ধু সতীর্থ শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনা শুনে আমার মনটা অস্থির হয়ে উঠলো। এ ছাড়া কামাল লোহানীর কণ্ঠে খবর পাঠ শুনে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললাম। ছুটলাম ফরিদপুর থেকে যশোরের মধ্য দিয়ে দুর্গম পথ মাড়িয়ে পায়ে হেঁটে, কোথাও নৌকায়, রাতের আঁধারে চুপিচুপি, কত বিপদ মাথায় নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে। মধুমতি পার হয়ে বনগাঁ দিয়ে কলকাতায় পৌঁছালাম। তখন কলকাতার কাকরগাছিতে আমাদের এলাকার অনেক ক্ষুদে ব্যবসায়ী ছিল। আমি তাদের কাছে আশ্রয় নিই। তারপর আমরা কয়েকজন কল্যাণী মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং সেন্টারে যাই। ওবায়দুর রহমান, এম এ রেজাসহ অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। কিছুদিন সেখানে ট্রেনিংয়ের কাজ চলতে থাকে। ওদিকে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনো খোঁজ না পেয়ে বন্ধু সিদ্দিক, শহীদসহ কয়েকজন আমরা হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরে আসি। তখন আমাদের গ্রামের অবস্থা অনেক খারাপ। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এলাকায় আমাদের বড় ভাই জাহাঙ্গীর, কানাই ভাইসহ আরও অনেকে প্রত্যক্ষভাবে কাজ শুরু করেছে। আমিও তাদের সাথে যোগ দিই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে ক’জন রাজাকারকে হত্যা করা হয়। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যখন মওলানা ভাসানীর ভাষণ শুনলাম তখন আবারও কলকাতা যাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তারপর আগের বর্ণিত সেই পথ ধরেই কলকাতা যাই এবং সেই এলাকার ব্যবসায়ী ভাইদের ওখানেই উঠি। তাদের সেই ঋণের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। এর মধ্যে বেগবাগানে মেনন ভাই, রনো ভাই, মহিউদ্দিন ভাইসহ অনেক নেতার সঙ্গে দেখা হয়। এরপর বালিগঞ্জের ফাড়ির কাছে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সন্ধান মেলে। দেখা হয় শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে। তিনিই স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশ নেওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন। স্বাধীনবাংলায় প্রথম গান রেকর্ডিংয়ের সেই ভালোলাগার অনুভূতির কথা কখনও ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অস্ত্র হিসেবে গানকেই তুলে নিলাম কণ্ঠে। স্বাধীনবাংলাতেই পরিচয় হয় দুই বাংলার নামকরা অনেক সুরকার, গীতিকার ও শিল্পীসহ অনেক গুণীজনের সঙ্গে। তারপর মিত্র বাহিনীর ঝাঁক ঝাঁক মিগ আর মুক্তিবাহিনীর প্রত্যক্ষ যুদ্ধ দেখে মুক্তিপাগল মানুষ উত্ফুল্ল হলো।
হানাদার বাহিনী দিশেহারা। এরপর এলো বিজয়ের চির উজ্জ্বল দিনটি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। কলকাতা থেকে দেশে ফিরে এলাম। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্ণ হলো, কিন্তু এখন আমার মনে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়—যে আশায় আমরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলাম, দেশকে মুক্ত করলাম দখলদার বাহিনীর হাত থেকে, তার কতটা আমরা পূরণ করতে পেরেছি? অনেক আশাই এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে। আমি আশাবাদী আমাদের তরুণরা সে লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হবে।