
জনতার নিউজ
কুড়িগ্রামের রৌমারী থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম ২০১৭ সালের ৫ আগস্ট যোগদান করেই মাদকের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। একের পর এক মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ কারবারিকে গ্রেপ্তার করে এলাকায় নজির সৃষ্টি করেন। ওসির এই কর্মকাণ্ডে উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ আশার আলো দেখতে পায়। পুলিশ সুপার তাঁকে ডেকে নিয়ে জেলার শ্রেষ্ঠ ওসির পুরস্কার তুলে দেন।
মূলত এর পরেই ওসির আসল রূপ বের হতে থাকে। মাদক নির্মূলের আড়ালে অনিয়ম, আটক বাণিজ্য ও সাজানো মামলায় মিথ্যা আসামি করে অর্থ আদায় শুরু করেন।
তাঁর নানা অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ছয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংসদ সদস্য। অভিযোগের পর ওসি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যাঁরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাঁদের হয়রানি শুরু করেন।
থানার পুলিশ ও এলাকাবাসী অভিযোগ করে, ওসি এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারিদের নিয়ে থানা ক্যাম্পাসের ভেতর সরকারি বাসভবনে ইয়াবার আড্ডা বসান। নেশার আসরে বসেন কর্তিমারী এলাকার নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে। এ সময় পুলিশ ভ্যান ও ফোর্সদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখেন।
আটক বাণিজ্য
অভিযোগে জানা গেছে, গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর মাঠের ভিটা এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বৃদ্ধ নুর আমিন নিহত হন। এ ঘটনায় সুরুজ্জামানকে আটক করা হয়। কিন্তু মামলা না করে এক লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর গোলাবাড়ীতে অভিযান চালিয়ে তাহিদুল ইসলাম, মঞ্জিল হোসেন, আমজাদ হোসেন, মোবারক হোসেন ও আব্দুস সবুর জুয়াড়িকে আটক করেন। ঘুষ না পেয়ে মারধরের একপর্যায়ে সবুর অচেতন হয়ে পড়লে দ্রুত থানা থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাড়িতে পৌঁছামাত্র সবুর মারা যান। চলতি বছরের ২০ মার্চ টাংড়াপাড়া গ্রামের আকবর আলী ও তাঁর ছেলে শাহ আলমকে বিনা কারণে আটক করে পুলিশ। গভীর রাতে ঘুষ নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেন ওসি। গত পহেলা বৈশাখে পুলিশ বিভিন্ন জুয়ার আসর থেকে ৪০ জনকে ধরে আনে। গভীর রাতে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা করে নিয়ে ১৬ জনকে ছেড়ে দেন ওসি।
গত ৩১ মে রাতে বড়াইকান্দির সাইফুল ইসলামের বাড়িতে মাদক আছে বলে পুলিশ তল্লাশি চালায়। কিন্তু কোনো মাদক না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় সাইফুলকে থানায় দেখা করতে বলা হয়। পরদিন সাইফুল থানায় গেলে ওসি তাঁর বিরুদ্ধে মাদকের মামলা রয়েছে বলে এক লাখ টাকা ঘুষ চান। পরে ভয় দেখিয়ে ৫১ হাজার টাকা নেন। এ নিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করায় ওসি ক্ষিপ্ত হয়ে আরো দুইবার থানায় নিয়ে এসে আড়াই লাখ টাকা ঘুষ নেন।
গত ৬ এপ্রিল মধ্যরাতে হাজিরহাটের মোস্তাকিন আহমেদ ও তাঁর ছেলে মমিনুল ইসলামকে পুলিশ বিনা অপরাধে আটক করে থানাহাজতে মারধর করে। পরে তাঁদের একটি হত্যা মামলায় জড়ানো হয়। ৪ এপ্রিল চরশৌলমারী থেকে আট জুয়াড়ি আটক করে পুলিশ। এর মধ্যে পাঁচজনকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গত বছরের ২ অক্টোবর সন্ধ্যারাতে পাটাধোয়া গ্রামের ওমানপ্রবাসী আব্দুর রহমানের স্ত্রী শিরিনা আক্তারকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন মাতব্বররা। শিরিনা তিন বছর ও সাত মাস বয়সী দুই সন্তান কোলে নিয়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার পথে জিঞ্জিরাম নদীর স্রোতের মধ্যে পড়েন। পাহাড়ি ঢলে দুই শিশু ভেসে যায়। তিন দিন পর লাশ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় মাতব্বরদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কিন্তু আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় ওসি মাতব্বরদের নাম বাদ দিয়ে মাকে দায়ী করেন। অভিযোগ আছে, মাতব্বরদের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ নেন ওসি।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার চরকাউরিয়া গ্রামের আবু মাজেদ রানা (৩৫) ও শিপুল ইসলাম (৩৪) পাওনা টাকার জন্য আসেন কর্তিমারী বাজারের কসমেটিক ব্যবসায়ী আক্তার হোসেনের কাছে। টাকা যাতে না দেওয়া লাগে এ জন্য পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করেন আক্তার। পরিকল্পিতভাবে গোয়ালগ্রাম বাজারে ১০৩ বোতল ফেনসিডিল দিয়ে আটক করা হয় তাঁদের। ওসির ফেসবুক পেজে উদ্ধার ১০৩ বোতল ফেনসিডিলসহ তিনজনের ছবি পোস্ট করা হয়। কিন্তু পরে একজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামলা দেওয়া হয়। বাকি দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয় দুই লাখ টাকায়।
মাদকের সাজানো মামলা
ফুলবাড়ী গ্রামের সোহরাব হোসেন কালু বলেন, ‘আমি আগে মাদক কারবার করতাম। ছেড়ে দিয়েছি। আবাদ করি। কিন্তু ওসি ১০০ বোতল ফেনসিডিল দিয়ে আমাকে ফাঁসিয়েছেন।’
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, দুবলাবাড়ী গ্রামের সাইদুর রহমান ও জয়েন উদ্দিনকে ভোগাচ্ছেন ওসি। এর মধ্যে জয়েনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকাও নিয়েছেন।
ধনার চর গ্রামের ছক্কু মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর তার দেওয়া তথ্য মতে, এএসআই আবু জাফরের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল পাঁচ হাজার ইয়াবার চালান আটক করে। কিন্তু বিশাল এই চালান ওসির বন্ধুর। ফলে তা ছেড়ে দিয়ে সোর্সকেই আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। তিন দিন আটক রাখার পর ৩৮৭ পিস ইয়াবা দিয়ে জেলহাজতে পাঠায়।’
ওসির অপকর্মের প্রতিবাদ করলে মামলা
ওসির অপকর্মের প্রতিবাদ করায় প্রায় অর্ধশত সাজানো মামলায় নিরীহ শতাধিক মানুষকে জড়ানো হয়েছে। অপকর্মের চিত্র তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করার কারণে দৈনিক যুগান্তরের উপজেলা প্রতিনিধি এস এম সাদিক হোসেন, মানবজমিনের রফিকুল ইসলাম সাজু, নয়া দিগন্তের মোস্তাফিজুর রহমান তারা ও সংবাদের আনিছুর রহমানকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
থানা সূত্র জানায়, ওসির বিশ্বস্ত এএসআই আবু জাফর। থানায় কোনো অভিযোগ এলে তা তদন্ত করার জন্য আবু জাফরকে পাঠানো হয়। অথচ একজন এএসআই কোনো মামলার তদন্ত করতে পারেন না। থানার একজন পুলিশ সদস্য বলেন, ‘জাফর হলেন ওসির ইয়াবা সেবনের সঙ্গী।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এসআই বলেন, ‘ওসি রাতে ইয়াবা সেবন করেন আর দিনে ঘুমান। তিনি রাতে আমাদের ঘুমাতে দেন না। অহেতুক ডিউটিতে পাঠান। ফলে সৎ ও সাহসী অফিসাররা তাঁকে এড়িয়ে চলেন। কেউ তাঁর কথা শুনতে চান না। বেশ কিছুদিন থেকে থানায় কোনো চেইন অব কমান্ড নেই।’ ওসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা সব মিথ্যা, বানোয়াট।’
কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার মেহেদুল করিম বলেন, ‘রৌমারী থানার ওসির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের পরই বলা যাবে আসল ঘটনা।’