■ আবদুল গাফফার চৌধুরী
বিএনপির সাবেক প্রথম সারির নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বিএনপিতে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং দল থেকে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেছেন। দলনেত্রী খালেদা জিয়া সম্প্রতি একটি হরতালের ডাক প্রত্যাহার করায় এবং সরকারবিরোধী হার্ডলাইন ত্যাগের আভাস দেওয়ায় ব্যারিস্টার হুদা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং নেত্রীর ওপর তার আস্থার কথা আবার ব্যক্ত করেছেন।
ব্যারিস্টার হুদার দলে ফেরার এই একক সিদ্ধান্তের তেমন গুরুত্ব দিতাম না, যদি তিনি বিএনপির মধ্যে একজন আপসপন্থি নেতা না হতেন এবং একবার (খালেদা জিয়ার প্রথম মন্ত্রিসভার আমলে) এই আপসের কথা বলায় মন্ত্রিত্ব না হারাতেন। এবারেও তিনি দল ছেড়েছিলেন বিএনপি দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতার পথে এগোচ্ছে না_ এই অভিযোগ তুলে। এখন তিনি বিএনপিতে ফিরে গেলে এবং তাকে ফিরতে দেওয়া হলে তার মতো আরও কিছু প্রবীণ নেতা যেমন খুলনায় শেখ রাজ্জাক আলী প্রমুখ যারা দলে বহুকাল যাবৎ কোণঠাসা হয়ে আছেন, তারাও হয়তো আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেন।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে আমি যখন ঢাকায় যাই, তখন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে ব্যারিস্টার হুদার সঙ্গে আমার দেখা। তিনিও সস্ত্রীক দেশে ফিরছিলেন। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভালো। তিনি তখন বিএনপি থেকে বেরিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে ফেলেছেন। যতদূর মনে পড়ে, হিথ্রোতে বসে রাজনৈতিক আলোচনার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমাদের নতুন দলটিকে এখনই একটি দল বলবেন না। এটা একটা প্রেসার গ্রুপ। যদি বিএনপিকে চাপ দিয়ে ঠিক পথে আনতে পারি, তাহলে নতুন দলের দরকার নেই। নইলে এই দল নিয়ে এগোতে হবে।
এ কথার রাজনৈতিক তাৎপর্য তখন অতটা বুঝিনি। এখন তার পুরনো দলে ফেরার উদ্যোগ দেখে মনে হয়, নেত্রী খালেদা জিয়া জামায়াতের ভুজবন্ধন ও হার্ডলাইন থেকে সরে এসে শান্তিপূর্ণ পথে অর্থাৎ সংলাপের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করতে এগিয়ে আসবেন বলে ব্যারিস্টার হুদা হয়তো ভাবছেন। সে জন্যই তিনি হয়তো পুরনো দলে ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করেছেন।
তার মতো আরও কিছু প্রবীণ বিএনপি নেতা যারা পরিচয়ে মডারেট এবং এখন নিষ্ক্রিয় অথবা দলছুট, তারা দলে ফিরে এসে খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়ালে দলের মনোবল ফিরবে এবং খালেদা জিয়াও বর্তমান হতোদ্যম অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবেন বলে অনেকে ভাবছেন। এটা আমারও ধারণা, বিএনপির হাইকমান্ড থেকে কোনো ধরনের অনুকূল আভাস পেয়েই ব্যারিস্টার হুদা হয়তো দলে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তিনি দলে ফিরতে পারলে আরও অনেক প্রবীণ মডারেট নেতা হয়তো দলে ফিরে আসবেন এবং যারা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন, তারা সক্রিয় হবেন।
ঢাকার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে মিলে এবং হেফাজতকে সামনে খাড়া করে কঠোর পন্থায় সরকারকে দাবি মানতে অথবা পদত্যাগে বাধ্য করার যে পরিকল্পনা বিএনপি করেছিল, তা ৫ মে শাপলা চত্বরে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ায় খালেদা জিয়ার সম্ভবত এই উপলব্ধি ঘটেছে যে, হুমকি ও সন্ত্রাস দ্বারা সরকারকে তারা কাবু করতে পারবেন না বরং নিজেরা অস্তিত্বের সংকটে পড়বেন। ইতিমধ্যেই তারা এ সংকটের মুখোমখি হয়েছেন। ফলে এতদিন পর তারা সংলাপ শুরু করার দ্রুত আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন এবং শর্তহীনভাবে সংলাপে বসার আভাস দিয়েছেন। সম্ভবত এ জন্যই মধ্যপন্থি প্রবীণ নেতাদের জন্য খালেদা জিয়া দলের দরজা আবার খুলে দিতে চান।
এক দল রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের এই বিশ্লেষণ কতটা সঠিক তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি। এ কথা সত্য, ৫ মের হেফাজতি তাণ্ডব এবং তার ব্যর্থতার পর হেফাজতিদের চেয়েও বিএনপি ও জামায়াতের মুখ পুড়েছে বেশি। হেফাজতিদের মাধ্যমে দেশে সরকারবিরোধী একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর পেছনে আসল কলকাঠি যে বিএনপি ও জামায়াত নেড়েছে, তা-ও এখন প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তাতে এই দুটি দলের শিবিরই এখন হতোদ্যম এবং দেশে এক ধরনের ‘অস্বস্তিকর শান্তি’ বিরাজ করছে।
তার অর্থ এই যে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানকে স্বচ্ছন্দে চলতে দিয়ে জামায়াত সন্ত্রাস সৃষ্টি থেকে সহজে বিরত হবে কিংবা বিএনপিকে তার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতে দেবে; অন্যদিকে বিএনপিও সহসা জামায়াতের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে তা মনে হয় না। গত কয়েক বছরে বিএনপির ভেতরে জামায়াতের শিকড় দৃঢ় প্রবিষ্ট হয়েছে। তা সহজে উৎপাটন করার মতো নয়। তারেক রহমান সাবালকত্ব অর্জন এবং বিএনপির নেতৃত্বে ও মায়ের প্রধান উপদেষ্টা পদে আরোহণের পর দল থেকে মডারেট প্রবীণ নেতাদের হটানোর ব্যবস্থা করেন এবং জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক অচ্ছেদ্য করার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা ও জামায়াতিরা একই পরিবারের লোক।’
এই রাজনৈতিক ও পারিবারিক বন্ধন সহজে ছিন্ন হওয়ার মতো নয়। ফলে বিএনপির মধ্যে জামায়াতবিরোধী মডারেট এবং জামায়াতপন্থি উগ্রবাদীদের একটা বিরোধ এখনও চলছে বলে অনেকে মনে করেন। মডারেটরা এতদিন দলে কোণঠাসা থাকলেও ৫ মের শাপলা চত্বরের ঘটনা তাদের আবার আশাবাদী করে তুলেছে হয়তো। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার দলে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত তারই আভাস কি-না তা দেখার রইল।
অন্যদিকে ৫ মের বিপর্যয়ে বিএনপির জামায়াপন্থি উগ্রবাদীরা সাময়িকভাবে কচ্ছপের মতো খোলসের মধ্যে মাথা লুকালেও দলকে সহজে সংলাপ ও সমঝোতার পথে যেতে দেবে, তা মনে হয় না। তার প্রমাণ, লন্ডনে তারেক রহমানের দীর্ঘ ৬ বছর পর প্রকাশ্য রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভাব এবং হাসিনা সরকারকে ফ্যাসিস্ট সরকার আখ্যা দিয়ে তীব্র ভাষায় আক্রমণ চালানো। ঢাকাতেও বিএনপি দ্রুত সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে তাগাদা দেওয়ার পরদিন আবার অপ্রত্যাশিতভাবে আগামী রোববার ২৬ মে হরতাল আহ্বান করেছে।
এই হরতাল ডাকার অজুহাত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সরকার এখনও মেনে নেয়নি এবং এক মাসের জন্য দেশে সভা-সম্মেলন বন্ধ রাখার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা। মজার ব্যাপার এই যে, সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে তাগাদা দিয়ে পরদিনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে (যে দাবিই হবে সংলাপের মূল বিষয়) হরতাল ডাকা হয়েছে। এটা কি কোনো রাজনৈতিক সুস্থ বুদ্ধির পরিচয়? দ্বিতীয়ত, দেশে এক মাসের জন্য রাজনৈতিক সভা-মিছিল ইত্যাদি বন্ধ রাখার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি বালকোচিত উক্তি করেছেন মাত্র, সরকার তা এখনও গ্রহণ করেনি। বরং সরকারি মহলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তিটি সমালোচিত হয়েছে। এ অবস্থায় চিলে কান না নিতেই সেই চিলের পেছনে দৌড়ানো কি কারও মানসিক সুস্থতার প্রমাণ?
আসলে বিএনপিতে একটি নীরব অন্তন্র্দ্বন্দ্ব এখনও চলছে মধ্যপন্থি, সংলাপে আগ্রহী এবং জামায়াতপন্থি উগ্রবাদীদের মধ্যে। খালেদা জিয়া তার সিঙ্গাপুর সফরের সময় পুত্রের জোর তাগাদায় মধ্যপন্থা ছেড়ে জামায়াতের সঙ্গে একীভূত হয়ে যান। তার বিশ্বাস ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারকে তারা এবার সহজেই কাবু করে ফেলবেন। তাই হাসিনা সরকারকে দাবি মানার জন্য ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে বলেছিলেন, ‘দাবি না মানলে (ক্ষমতা ছেড়ে) পলায়নের পথ পাবেন না।’
হাসিনা সরকার অত্যন্ত ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন_ বিএনপি কী করবে? প্রথম রাউন্ডের শোডাউনে জয়ী হতে না পেরে সংলাপে যাবে, না কিছুদিন শান্তি বজায় রেখে শক্তি সঞ্চয়পূর্বক আবার সংঘাতে নামবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে নির্বাচন বানচালের তৎপরতা চালাবে?
বিএনপির প্রবীণ মডারেট নেতারা দলের নেত্রীর ওপর কতটা প্রভাব খাটাতে পারবেন জানি না। তবে অনুমান হয়, বিএনপি নেত্রী আশা করছেন (যে কারণে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এত গোঁ ধরেছেন), তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে জেলে পাঠাবে না এবং দীর্ঘ জামিনভোগের সুযোগ দেবে। তারেক রহমান দেশে ফিরে এলে দলের কর্মীদের মনোবল বাড়বে, চাই কি তারেক রহমান নির্বাচন জয়েরও একটা কৌশল বের করতে পারবেন।
বর্তমান সরকারের কাছ থেকে তারেক রহমান সংক্রান্ত কোনো আশ্বাস পেলে বিএনপি সংলাপে যাবে এবং নির্বাচনেও যাবে বলে অনেকের মতো আমারও ধারণা। কিন্তু এই আশ্বাস না পেলে দলটি সংলাপে বসবে কি-না সন্দেহ রয়েছে। যদি সংলাপে যায়ও, কোনো একটা অজুহাতে তা ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে আসবে। নতুন করে সংঘাত শ্ররু করার প্রস্তুতি নেবে।
দীর্ঘ ৬ বছর পর তারেক রহমানের প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা, ওমরাহ করার নামে সৌদি আরবে গমন, সেখানে সভা ডেকে সরকারবিরোধী কঠোর বক্তব্য রাখা, সিঙ্গাপুর সফররত মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পূর্ণ ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া দলকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়াসেরই অংশ। তিনি দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মায়ের ‘হেয়ার এপারেন্ট’। সুতরাং দলের ওপর তার কর্তৃত্বই বেশি। তিনি চান না, এই কর্তৃত্ব আবার মডারেট প্রবীণ নেতাদের হাতে চলে যাক।
ফলে হেফাজতি তাণ্ডবের ব্যর্থতার পর মডারেটদের দলে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিতেই তারেক রহমান লন্ডনে বসে প্রকাশ্য রাজনীতিতে তৎপর হয়েছেন। সম্প্রতি পূর্ব লন্ডনে দলের ইউরোপীয় নেতাকর্মীদের ডেকে তিনি কঠোর ভাষায় হাসিনা সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং সরকার উৎখাতের ডাক দিয়েছেন। সম্ভবত এটা তার মায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি, যাতে তিনি পুত্রের নিরাপদে দেশে ফেরার নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত সংলাপে না বসেন অথবা আপস না করেন। সে জন্যই সংলাপে বসার জন্য সরকারকে তাগিদ দেওয়ার পরদিনই বিএনপি আবার রোববার হরতালের ডাক দিয়েছে কি-না অর্থাৎ আবার সংঘাতের পথে যেতে চায় কি-না তা এখন হিসাব-নিকাশের ব্যাপার।
এই লেখাটা শেষ করে এনেছি, এমন সময় খবর এলো বিএনপির অন্যতম প্রধান নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ছবি গাছে ঝুলিয়ে যুবদলের নেতাকর্মীরা জুতা মেরেছে এবং তাকে দালাল দালাল বলে গালি দিয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদের অপরাধ_ তাহের হত্যায় জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা সম্পর্কে তার একটা বইয়ে মন্তব্য আছে এবং তাহের হত্যা মামলার সাম্প্রতিক রায়ে বিচারপতিরা সেটা উল্লেখ করেছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ বিএনপির মডারেট নেতা নন, বহুরূপী নেতা। তবু তার ভাগ্যে এই শাস্তি জুটেছে। এতেই প্রমাণ হয়, দলের নিয়ন্ত্রণ এখনও তারেক অনুসারীদের হাতে এবং খালেদা জিয়া সহজে তাদের প্রভাবমুক্ত হতে পারবেন না।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের ধারণা, দলের মডারেট নেতা ও আন্তর্জাতিক চাপে খালেদা জিয়া হয়তো সংলাপে রাজি হবেন, তারেক ইস্যুতে কোনো কিছু না হলে কোনো অজুহাতে বেরিয়ে আসবেন। তখন বিএনপি আবার জামায়াতের সহযোগিতায় সংঘাতের পথে যেতে চাইবে। আগামী নির্বাচনের সময়টি দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা যাবে দেশ সংলাপ, না নতুন সংঘাতের পথে এগোচ্ছে। আমার আশঙ্কা, ঈশান কোণের মেঘ দ্রুত সরে যাবে না।
সূত্র: দৈনিক সমকাল