Home
জাতীয় আজি দখিন-দুয়ার খোলা, এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো…।


আজি দখিন-দুয়ার খোলা/ এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো…। ‘দখিন সমীরণের শিহরণ’ জাগানোর মাহেন্দ্র দিন এলো। মাতাল হাওয়ায় কুসুম বনের বুকের কাঁপনে, উেরাল মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে উঠবার আভাসে, পল্লব মর্মরে আর বনতলে কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে: ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে…। আজ বিপুল ঐশ্বর্যের ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন।
আজ পয়লা ফাল্গুন। গণমানুষের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক/ আজ বসন্ত…’ এমন মধুর লগনে প্রকৃতি আর প্রাণের আপন উচ্ছ্বাস উত্সবের রঙে ঢঙে মদিরায় মেতে ওঠে। আজ হূদয়দল খোলার দিন। অদ্ভুত এক শিহরণ এখন। মনে তো বটে। সেইসঙ্গে বনেও। রূপ লাবণ্যে জেগে উঠেছে প্রকৃতি, রঙিন চারপাশ। বৃক্ষের নবীন পাতায় আলোর নাচন! গোলাপ, জবা, পারুল, পলাশ, পারিজাতের হাসি। ঘরছাড়া মৌমাছি। কবিমনকেও চাঞ্চল্যে ভাসিয়ে নেয়। সেই প্রাচীন প্রাকৃত পেঙ্গলের দিকে তাকালে আমরা দেখবো বসন্তরাজের করতলে ভালোবাসার নৈবেদ্য তুলে দিতে কেমন ব্যস্ত কবিরা। বসন্তের বন্দনা করে একটি পংক্তিও লেখেননি, এমন বাঙালি কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভানুসিংহ ঠাকুরের উতলা চিত্তের আকুলতা এমন— ‘বসন্ত আওলরে! মধুকর গুণগুণ,/অমুয়া মঞ্জুরী কানন ছাওলরে।/ মরমে বহই বসন্ত সমীরণ, মরমে ফুটই ফুল/ মরমকুঞ্জ’পর বোলই কুহুকুহু অহরহ কোকিলকুল…।’
শীতের রিক্ততা মুছে দিয়ে প্রকৃতিজুড়ে আজ সাজ সাজ রব। হিমেল পরশে বিবর্ণ প্রকৃতিতে জেগে উঠছে নবীন জীবনের ঢেউ। নীল আকাশে সোনা ঝরা আলোকের মতই হূদয় আন্দোলিত। আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে…। ‘আহা আজি এ বসন্তে /কত ফুল ফোটে কত বাঁশি বাজে/কত পাখি গায়…। নবপুষ্প পত্র-পল্লবে, প্রকৃতিতে সাজ সাজ রব। কুঁড়িদের ওষ্ঠপুটে লুটছে হাসি ফুটছে গালে টোল। অশোকে-অশ্বত্থে-শিরীষে-শালে-পিয়ালে হাওয়ার নাচন, আলোর কাঁপন যখন তখন মাতামাতির দিন এখন। ঋতুরাজ বসন্তের দিনগুলো মধুরেণ মায়াবী এক আবেশ ঘিরে রইবে বৃক্ষ, লতা, পাখ-পাখালী আর মানুষকে। এ ফাগুন সুখের মতো এক ব্যথা জাগিয়ে দেবে চিত্তে: ‘এতটুকু ছোঁয়া লাগে, এতটুকু কথা শুনি/তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী…।’
সাগর, নদী, ভূ-ভাগ গ্রীষ্মের তাপ বাষ্পে নিঃশ্বাস নিবার আগে এ বসন্তের ফাল্গুনে পায় শেষ পরিতৃপ্তি। নৈসর্গিক প্রকৃতি বর্ণচ্ছটায় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতই বাঙালি তরুণ মনে লাগে দোলা। হূদয় হয় উচাটন। ফুল ফুটবার পুলকিত দিন বসন্ত। বন-বনান্তে, কাননে কাননে-পারিজাতের রঙের কোলাহল, আর বর্ণাঢ্য সমারোহ। ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো’ কবিগুরুর এই পুলকিত পংক্তিমালা বসন্তেই কি সকলের বেশি মনে পড়ে? বনে বনে রক্তরাঙা শিমুল-পলাশ, অশোক-কিংশুকে বিমোহিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/ খুনেরা ফাগুন…।’
কেবলই বিপ্লবী সুরে নয় মিষ্টি সুরের বাঁশী বাজিয়েও নজরুল বসন্ত বন্দনা করেছেন— ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত ’। শীতে খোলসে ঢুকে থাকা বনবনানী অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠে এ বসন্তে। পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। প্রকৃতিতে চলে মধুর বসন্তে সাজ সাজ রব। আর এ সাজে মন রাঙিয়ে গুন গুন করে অনেকেই আজ গেয়ে উঠবেন— ‘মনেতে ফাগুন এলো…’।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে কে আর বেশি বসন্ত বিলাসী এ বাংলায়। তার বসন্ত গীত যে বিরাজ করে প্রতি বাঙালির হূদয়েই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য কবিতা ও গানে উঠে এসেছে বসন্তের কথা। মাত্র তিন লাইনেও কবি গুরু বসন্তকে চিনিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন— ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে/এত বাঁশি বাজে/ এত পাখি গায়…।’
বসন্ত বাতাসে পুলকিত ভাটিবাংলার কণ্ঠ শাহ আবদুল করিম গেয়ে ওঠেন:‘বসন্ত বাতাসে…সই গো /বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে…।
ঋতুচক্র এখন যেন আর পঞ্জিকার অনুশাসন মানছে না। কুয়াশার চাদরমোড়া অকাল শীত তার তীব্রতা ছড়াতে না ছড়াতেই বিদায় নিল। প্রকৃতির দিকে তাকালে শীত বরষার মত বসন্তকেও সহজে চেনা যায়।
শীতের জরাগ্রস্ততা কাটিয়ে নতুন পাতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠছে রিক্ত বৃক্ষাদি। বেশুমার বনফুল হতে গুন গুন করে মৌ-পরাগ আহরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মধুমক্ষিকা। বিচিত্র সব মুকুলের মদির সুবাসে মন-প্রাণ হিন্দোলিত হয়ে উঠছে, আদিগন্ত ফাগবেশ আর ব্যঞ্জনাময় উত্সব-আমেজ মানুষ মাত্রকেই আকৃষ্ট করে। এই জন্যই ধন্য বসন্তের করোটিতে ‘ঋতু রাজের মুকুট।’
বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি সেই অনাদিকাল থেকেই। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই পেয়েছে নানা অনুপ্রাস, উপমা, উেপ্রক্ষায় নানাভাবে। হালে শহরের যান্ত্রিকার আবেগহীন সময়ে বসন্ত যেন কেবল বৃক্ষেরই, মানুষের আবেগে নাড়া দেয় কমই। কবির ভাষায়— মানুষের হূদয় আজ আনন্দে ভরে উঠুক/দুঃখগুলি সব ঝরে যাক/মানুষের মন হোক অনন্ত/আজ যে বসন্ত…।
বসন্তকে বরণ করা হচ্ছে আজ। প্রকৃতির যা-ই আমাদের অবশিষ্ট আছে সেটাই সাজবে আজ। ফুল এখন এই বসন্তে ফুটবে গাছ কম থাক আর বেশি যা-ই থাক। তবে গাছ থাক না থাক, ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক, আজ বসন্ত।’
যদি কুসুমিত প্রকৃতির দর্শন এই নগরীতে না মেলে তবে সেমন্তী ঘোষের কবিতার মতো— ‘এমন চমত্কার মিঠে দিনে/ বসন্তের কথা থাক/বরং অনলাইনে থাকা যাক/ বরং মেসেজে মেসেজ ভেসে যাক’…।