Home
রাজধানী অবৈধ গ্যাস সংযোগের পেছনে তিতাসের এমডি *তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে *মন্ত্রী বললেন,...

রাজধানী ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও বিতরণের সাথে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নওশাদ ইসলামসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি অংশ জড়িত রয়েছেন। এজন্য প্রধান ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটি সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছেন। তারা বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে বিতরণ লাইন ও সার্ভিস লাইন স্থাপন করে বিপুল সংখ্যক আবাসিক চুলা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন। এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে খোদ তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিতাস অধিভুক্ত এলাকায় অবৈধভাবে স্থাপিত বিতরণ লাইন ও অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনায় গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের ২০ অক্টোবর তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিটিডিসিএল) পরিচালনা বোর্ড তিন সদস্যের এ উচ্চতর কমিটি গঠন করে। প্রায় সাড়ে তিনমাস তদন্তশেষে গত ৮ ফেব্রুয়ারি কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কোম্পানীর আওতাধীন প্রায় সব এলাকাতেই কম-বেশি অবৈধ গ্যাস বিতরণ ও সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও কালিগঞ্জ এলাকায় অবৈধভাবে স্থাপিত বিতরণ লাইনের পরিমাণ অনেক বেশি। তদন্ত কমিটিকে তিতাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অবৈধ বিতরণ লাইন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাকালে কিছু কিছু এলাকায় অবৈধ লাইন স্থাপনকারী, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং এলাকাবাসীর বাধার কারণে অবৈধ গ্যাসলাইন অপসারণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতীয়মান হয় যে, অবৈধ সংযোগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামের আড়ালে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতৃত্বে কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।’
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কমিটির চাহিদাকৃত তথ্য না পাওয়ায় তদন্ত কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গরূপে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। আবাসিক গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ অবৈধ সংযোগ রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ শিল্পখাতে অবৈধ সংযোগ ও লোডবৃদ্ধি রয়েছে। শিল্পখাতে অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রায় ৩০০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্যাস সংযোগ পেতে ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক এবং তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক খান মঈনুল ইসলাম মোস্তাক বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পর্ষদের চেয়ারম্যান ও জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি পেয়েছি। প্রতিবেদনে উল্লেখিত ঘটনা ও অভিযোগগুলো গুরুতর। সেগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন দুর্নীতিকে ছাড় দেয়া হবে না।
এদিকে তিতাস কর্তৃপক্ষ চাহিদা অনুযায়ী তথ্য না দিলেও বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী তদন্ত কমিটির কাছে হয়রানি ও দুর্নীতির অভিযোগ এবং প্রমাণ দিয়েছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান গাজীপুরের কালিয়াকৈর স্থাপিত ঊর্মি নিটওয়্যার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইলিয়াস হোসেন স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রে বলা হয়, আমরা কোন উপায় না পেয়ে তিতাস গ্যাসের কয়েকজন কর্মকর্তার অবৈধ অর্থ আদায় থেকে নিষ্কৃতি লাভের আশায় সহানুভূতি ও সাহায্যের জন্য আবেদন করছি। তিতাস গ্যাসের ভালুকা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক মশিউর, ফতুল্লা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক শহিরুল এবং চন্দ্রা অফিসের উপ ব্যবস্থাপক তোরাব মিলে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ ও অর্থ আদায়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ ইসলামের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সিন্ডিকেটটি পরিচালিত হচ্ছে।
চিঠিতে ঊর্মি নিটওয়্যারের এমডি জানান, সিন্ডিকেটের সদস্য তোরাব প্রতিমাসে ২ থেকে তিন লাখ চাঁদা দিতে তাকে বাধ্য করছেন। তোরাবের ব্যাংক হিসাবে দেয়া টাকার প্রমাণ হিসেবে ৫টি জমা স্লিপের ফটোকপিও তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেন তিনি। গত ১৯ নভেম্বর দেয়া ঐ চিঠিতে ইলিয়াস হোসেন বলেন, কিছুদিন আগে তিতাসের ভালুকা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক মশিউর আমাকে হুমকি দেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এমডি আমাদের লোক। ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। নইলে আদালতের রায় নিয়েও গ্যাস সংযোগ রক্ষা করতে পারবেন না।’ এর আগে ২০১৫ সালের ২০ মে কারখানার গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তিতাস কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী সময়ে রিট মামলার মাধ্যমে ৩৫ দিন পর গ্যাসের পুনঃসংযোগ পাই। এরপর মশিউর প্রতিমাসে ৫ লাখ টাকা দেয়ার জন্য দাবি করেন। মশিউরের হুমকির পর শহিরুলও একই কায়দায় মোবাইলে ফোন করে ভয় দেখায় ও দাবিকৃত টাকা না দিলে সমস্যায় পড়তে হবে বলে হুমকি দেয়। ইতিমধ্যে গত ২০১৫ সালের ১২ জুলাই ও ২৩ সেপ্টেম্বর মশিউরকে ৫ লাখ করে ১০ লাখ টাকা দেয়া হয়। এছাড়া জাকিরের নামে ১২ লাখ ও ১৩ লাখ টাকার পৃথক দুইটি চেক শহিরুলের কাছে দেয়া হয়।
এদিকে তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকার ১৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বা বরাদ্দের চেয়ে বেশি গ্যাস-লোড নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ঐ প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- গাজীপুরের ট্রপিক্যাল নিটেক্স, পিএন কম্পোজিট, গ্যালাক্সি সোয়েটার্স এন্ড ইয়ার্ন ডাইং, জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস, ডন বাংগ ডাইং, ডালাস ফ্যাশন, দ্যাটস ইট নীট, তালহা ফেব্রিক্স, ফার সিরামিক, ভিয়েলাটেক্স স্পিনিং মিল মিলস; ময়মনসিংহের আকবর কটন মিলস, পিত্র নীট কম্প্রোজিট, রিদিশা স্পিনিং মিলস, পাঠান সিএনজি, নাইস ডেনিম, এক্সপেরিয়েন্স টেক্সটাইল এবং নারায়ণগঞ্জের হোসেন হোসিয়ারী ও এম এস সরকার হোসিয়ারী। এর বাইরেও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও লোডবৃদ্ধি রয়েছে। কিন্তু তিতাসের সংশ্লিষ্টদের কাছে তথ্য চেয়েও না পাওয়ায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত পরিচালনা করা যায়নি।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে গতকাল সোমবার তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. নওশাদ ইসলামের মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেনি। এর আগে গত বুধবার দুপুরে তিতাসের প্রধান কার্যালয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও এমডির বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঐ সময় তিনি অফিসে উপস্থিত ছিলেন না।
তিতাস গ্যাস ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় গ্যাস সরবরাহ করছে। দেশের ৩০ লাখ গ্যাস গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ২০ লাখই এ কোম্পানির সেবা নেয়। এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা ১৮ লাখ ৮০ হাজার ৩৫৩। ১০ হাজার ৯১৩টি বাণিজ্যিক এবং ৪ হাজার ৫৯০টি শিল্প গ্রাহক রয়েছে। কিন্তু বৈধ পাইপলাইন ও সংযোগের বাইরেও বিপুলসংখ্যক অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে।